এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বিশ্ব চলচ্চিত্র অঙ্গনে ইরানি ছায়াছবি ইতিমধ্যেই শক্ত একটা আসন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। কট্টর ইসলামপন্থী দেশ হওয়া সত্ত্বেও চলচ্চিত্রের মতো একটা শিল্পের ক্রমাগত বিকাশ রীতিমত বিস্ময়কর। ইরানি ঘরানার ছবিগুলো একেবারে আলাদা ধাঁচের, কিন্তু সহজ ও সাবলীল জীবনের কথা বলে। সমাজ বাস্তবতা কিংবা জীবনের নানামুখি জটিলতাই সেখানে মুখ্য।
মাজিদ মাজিদির বারান কে সেই অর্থে ইরানি চলচ্চিত্র বিপ্লবের অব্যাহত ধারার প্রতিনিধিত্বশীল চলচ্চিত্র হিসেবে ধরা যেতে পারে অনায়াসে। আফগান শরণার্থী সমস্যার পটভূমিতে আবর্তিত বারান শেষ পর্যন্ত কেবল সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক সমস্যার আবর্তেই বন্দী থাকে নি। বারান হয়ে উঠেছে এক অনবদ্য মানবিক সম্পর্কের উপাখ্যান।
কাউকে কিছু উজার করে দিতে পারাটাই ভালবাসা। যাকে উজার করে দেয়া যায়, তাকেই আমরা ভালবাসি। এ দেয়া কখনও কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় না। বরং নিজেকে নিঃস্ব করার এক আদিম নেশা থেকে। কিন্তু সবাই নিজেকে নিঃস্ব করতে পারে না। সবার সে ক্ষমতা থাকে না। যাদের থাকে তাদেরই একজন লতিফ। বারান চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ভালবেসে নিঃস্ব হতে চাওয়া মানুষগুলোর প্রতিনিধি। প্রিয়া চলে যাচ্ছে আরেক দেশে। পিছনে পড়ে যাচ্ছে সব। হয়তো দেখা হবে না আর কোন দিন। তাতে কি, স্মৃতি তো আছেই!
সতের বছরের লতিফ ইরানের একটা কনস্ট্রাকশন ফার্মে কাজ করে। চা-বানানো, ফুট ফরমাশ খাটা এসবই তার কাজ। হঠাৎ লতিফের জীবনে কিশোরী বারানের আবির্ভাব গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেই সাথে লতিফের প্রেমিক মনকেও জাগিয়ে তোলে ভয়ংকর ভাবে। কিন্তু সবে চৌদ্দ পার করা আফগান রিফিউজি বারানের পক্ষে সে প্রেমে সাড়া দেয়া অতটা সহজ ছিল না। বারান সাড়া দেয়ও নি। তবুও লতিফ ছাড়ে নি, নিজেকে বিসর্জনের আয়োজনে।
বারান একটি স্পষ্টত সবাক চলচ্চিত্র হলেও এর গভীরে ঢোকার জন্যে দর্শককে সব গুলো ইন্দ্রিয়ই প্রয়োগ করতে হয়। প্রতিটি দৃশ্যই নিজের মতো করে ভাবার অবকাশ রেখে দিয়েছেন পরিচালক মাজিদ মাজিদি।
ছবির গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে খুব সহজেই একাত্মাতা অনুভব করা যায়। গল্পের গতি ও পয়েন্ট অব ভিউ এর জোড়াল ব্যাবহার মাজিদির আগের ছবিগুলোতে বোধহয় অতোটা দেখা যায় নি। প্রচলিত সরলরৈখিক বা লিনিয়ার ধারায় নিখাদ এক গল্প বলে গেছেন পরিচালক। সেখানে নারীদের প্রতি নেই নারীবাদী দৃষ্টি ভঙ্গি। অতি মানবীয় কোন ঘটনা কিংবা চরিত্রও সেখানে অনুপস্থিত। তাই এ গল্প সহজেই সবার গল্প হয়ে উঠতে পারে আনায়াসেই। এই গল্পের একজন হয়ে ওঠাটা তাই দর্শকের কাছে কঠিন কিছু নয়।
যুদ্ধ-দারিদ্রতাকে পেছনে রেখে বারান এক অনবদ্য ভালবাসার গল্প হয়ে উঠতে পেরেছে। দারিদ্রতা এখানে অনুষঙ্গ মাত্র। যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরাও এ ছবির উদ্দেশ্য নয়। তবে যুদ্ধের মানবিক বিপর্যয় প্রাসঙ্গিক ভাবেই শক্তিশালী ভাবে উঠে এসেছে।
ছবির চিত্রনাট্য বেশ শক্তিশালী। অসাধারন সেট ডিজাইনিং অনন্য এক নান্দনিকতার পরিচয় দেয়। ছবিতে অহেতুক ব্যাকগ্রউন্ড মিউজিকের অত্যাচার নেই। পুরো ছবিতে লতিফের প্রাপ্তি বারানের সাথে নিশ্চুপ কয়েকটা সেকেন্ড। এতেই পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ সে। অর্থের হিসেবে তা কখনই নয়। আর সুখ বিষয়টার সাথে অর্থ বিষয়টাও কখনও যায় না। সব বিসর্জন দেয়া লতিফের মুখের হাসি অন্তত সে কথাই বলে। তাঁর স্বপ্নের মানসী সারা জীবনের জন্য তাঁর মনে ছাপ রেখে গিয়েছে। সেই এক পাটি জুতোর ছাপই বা কম কিসে?